সাগরকন্যা কুয়াকাটা ভ্রমন



সাগরকন্যা কুয়াকাটা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। সাগরের বুকে চিরে কাসার থালার মত উদয় হওয়া অার রক্তিম অাভা ছড়াতে ছড়াতে অস্ত যাওয়া সূর্যের অাকর্ষনে হাজারো পর্যটক প্রতিবছর এখানে ভীড় জমায়। কুয়াকাটা সৈকতের মোট দৈঘ্য ১৮ কিমি দীর্ঘ।



কী কী দেখবেন?
===========
সৈকত এলাকাঃ
সৈকতের কাছেই রয়েছে একটা বৌদ্ধ মন্দির যা আপনার মন কেড়ে নেবে। পাশেই আছে রাখাইন মার্কেট। চাইলে এখান থেকে কেনা-কাটা করতে পারেন।এখানে পাবেন সুন্দর সুন্দর তাঁতের কাজ করা কাপড়। সৈকতের ঝাউবন থেকে কিছু দূরেই রয়েছে নয়নাভিরাম কুয়াকাটা ইকো পার্ক।
কুয়াকাটায় অাসা পর্যটকদের মূল অাকর্ষনের একটি হলো সূর্যোদয় দেখা। সূর্যোদয় দেখার উত্তম স্থান সৈকত থেকে কিছুটা দূরে কাউয়ার চর। এখান থেকে সূর্যোদয় দেখার দৃশ্য যে একবার দেখেছে সে কখনো ভুলতে পারবে না। কাউয়ার চরে বোনাস হিসেবে দেখার সুযোগ পাবেন লাল কাঁকড়ার ছুটোছুটি।



কিলোমিটার ১০টাকা হিসেবে বাইক ভাড়া করে সৈকতে বাইক চালাতে পারেন। ট্রলারে করে সাগরের বুকে ঘুরতে যেতে পারেন কিছু সময়ের জন্য। সমুদ্রের পানি যদি গায়ে লাগাতে চাইলে, তাহলে বিনা দ্বিধায় নেমে পড়তে পারেন সাগরের পানিতে। এখানে চোরাবালি বা গুপ্ত খাল না থাকায় এ সৈকত বেশ নিরাপদ।
সব শেষে প্রিয়জনের সাথে এক মনে দেখে নেবেন সূর্যাস্তের সেই হৃদয় ভোলানো দৃশ্য। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল নির্জনতা। ঢেউ এর গর্জন, তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ আপনাকে অন্য জগতে নিয়ে যাবে। সাগরের সাথে একাত্ম হওয়ার এমন সুযোগ কখনোই হারাবেন না।

শুঁটকি পল্লীঃ
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে অসংখ্য জেলের বাসস্থান রয়েছে। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এখানে চলে শুঁটকি তৈরির কাজ। অাগ্রহ থাকলে যেতে পারেন। এখানে কম দামে ভালো মানের শুঁটকিও কিনতে পাওয়া যায়।

গঙ্গামতির জঙ্গল ও ক্রাব আইল্যান্ডঃ
পূর্ব দিকে সৈকত শেষ হয়েছে গঙ্গামতির খালে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে গঙ্গামতির জঙ্গল। অনেকে একে গজমতির জঙ্গলও বলে থাকেন। নানান রকম বৃক্ষরাজি ছাড়াও এ জঙ্গলে আছে বিভিন্ন রকম পাখি, বন মোরগ-মুরগি, বানর ইত্যাদি।
গঙ্গামতির জঙ্গল ছাড়িয়ে আরও সামনে গেলে ক্রাব আইল্যান্ড বা কাঁকড়ার দ্বীপ। এখানে লাল কাঁকড়ার বসবাস করে। নির্জনতায় সৈকত লাল করে ঘুরে বেড়ায় তারা। ভ্রমণ মৌসুমে (অক্টোবর-মার্চ) কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে স্পিড বোটে ক্রাব আইল্যান্ডে যাতায়াত অাপনাকে রোমাঞ্চিত করবে সন্দেহ নেই।

ফাতরার বনঃ
সৈকতের পশ্চিম পাশে নদীর ওপারে ফাতরার বন নামে পরিচিত সুন্দরবনের শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল-এর অবস্থান। সুন্দরবনের সব বেশিষ্ট এ বনে থাকলেও হিংস্র প্রাণী নেই এখানে। বন মোরগ, বানর আর নানান পাখি আছে এ বনে। এখানে যেতে হবে ইঞ্জিন নৌকায়।

কুয়াকাটার কুয়া ও রাখাইন পাড়াঃ
সৈকতের কাছে রাখাইনদের বাসস্থল কেরাণিপাড়ার শুরুতেই প্রাচীন কুয়ার অবস্থান-যার নামানুসারে এ সৈকতের নাম হয়েছে কুয়াকাটা। জনশ্রুতি আছে ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে বহু রাখাইন জায়গাটি ছেড়ে নৌকাযোগে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন। চলতি পথে তারা বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙ্গাবালি দ্বীপের খোঁজ পেয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। সাগরের লোনা জল ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মিষ্টি পানির জন্য তার এখানে একটি কূপ খণন করেন। এরপর থেকে জায়গাটি কুয়াকাটা নামে পরিচিতি পায়। এখানকার রাখাইন নারীদের প্রধান কাজ কাপড় বুণন। রাখাইনদের তৈরি শীতের চাদর বেশ আকর্ষণীয়।

সীমা বৌদ্ধ মন্দিরঃ
কুয়াকাটার প্রাচীন কুয়ার সামনেই সীমা বৌদ্ধ মন্দির। কাঠের তৈরি এই মন্দির কয়েক বছর আগে ভেঙে দালান তৈরি করা হয়েছে। তবে মন্দিরের মধ্যে এখনও আছে প্রায় ৩৭ মন ওজনের প্রাচীন অষ্টধাতুর তৈরি বুদ্ধ মূর্তি।




যাবেন কিভাবে?
===========
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ৩৮০ কিমি। বরিশাল থেকে ১০৮ কিমি। পটুয়াখালী খালি থেকে ৭০ কিমি, কলাপাড়া থেকে ২৫ কিমি। অাপনি যেতে পারেন বিভিন্নভাবে। নিচে সবক’টি রুটের যাতায়াত ব্যবস্থা তুলে ধরা হলো-

ঢাকা থেকে-
ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়াকাটার বাস রয়েছে। ভালো বাসের মধ্যে সাকুরা পরিবহন ও দ্রুতি পরিবহন-এর কথা বলা যেতে পারে । এ বাসগুলোর ভাড়া ৭০০/- এর মত। তবে গাবতলি থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার অারো অনেক বাস আছে।এগুলোর ভাড়াও বিভিন্ন রকম।
মাওয়া হয়ে যেতে চাইলে সায়দাবাদ থেকে সকাল ৬:৩০ এ পটুয়াখালীর বাসে (ভাড়া ৩৫০/-; সময় লাগবে ১০/১১ ঘন্টা) উঠবেন। আমতলী নেমে সেখান থেকে খেপুপাড়া হয়ে যেতে হবে কুয়াকাটা।আমতলী থেকে খেপুপাড়া ৩৫ টাকা। খেপুপাড়া থেকে কুয়াকাটা বীচ পর্যন্ত ১০০ টাকা ।

লঞ্চ রুট
======
বরিশাল হয়ে:
বরিশালের বিলাসবহুল লঞ্চে করে যেতে পারেন।বিকেল বেলা বরিশালের লঞ্চে উঠে সকালে বরিশাল লঞ্চঘাট নেমে সেখান থেকে ১০-১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে চলে আসুন নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ড। এইখান থেকে কুয়াকাটার বাস পাবেন। ঢাকা থেকে প্রতি রাত ৮.৩০ মি: এ ৩-৪ টি লঞ্চ বরিশালের উদ্দ্যেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া ডেক ২০০ টাকা, কেবিন ৯০০/১৭০০ টাকা (সিংগেল/ডাবল)। অবশ্য ভাড়া লঞ্চ এবং টিকেটের ধরণ অনুযায়ী বেশ পার্থক্য হয়ে থাকে।
পটুয়াখালী হয়ে-

ঢাকা থেকে সরাসরি পটুয়াখালী যেতে পারেন লঞ্চে করে। এ রুটের ভালো লঞ্চের মধ্যে সুন্দরবন-৯ (০১৭৬৮-৯৯২৪২৬) কুয়াকাটা-১ (+৮৮০ ১৭৩৬৬২০৫৮০) কাজল-৭ (যোগাযোগঃ +৮৮০ ১৭৯৮৮৪৯৭৪৭), সুন্দরবন-১১ (+৮৮০১৭১১-৩৫৮৮৩৮) উল্লেখযোগ্য। ডাবল বেড কেবিনঃ ১৮০০ টাকা, ফ্যামিলি বেড কেবিনঃ ২৪০০-২৫০০ টাকা, ভি আই পি কেবিনঃ ৩০০০-৩৫০০ টাকা।সন্ধ্যা ৬.৩০ এ পটুয়াখালীগামী লঞ্চ সদরঘাট ছেড়ে যায়। পুটুয়াখালী নেমে সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা। পুটুয়াখালী বাস স্টেশন থেকে প্রতি ঘন্টায় কুয়াকাটার বাস ছাড়ে। ভাড়া ৬০-৭০ টাকা।

কোথায় থাকবেন?
===========
সাশ্রয়ী, ব্যয়বহুল সব রকম হোটেলই অাছে । সৈকত নিকটবর্তী হোটেলগুলোতে উঠা ভালো। সমুদে্রর বাতাস উপভোগ করার সুযোগ পাবেন।
সমুদ্রের কাছে-

হোটেল নিলাঞ্জনা 01829 44 00 44, হোটেল গ্রেভার ইন (01748723557), হোটেল সৈকত, স্কাই কটেজ 01711-542881।, হোটেল স্কাই প্যা লেস (01727507479)। যমুনা হোটেল এ্যন্ড রিসোর্ট (01815-701329), কিংস হোটেল (01971-841599)।
সমুদ্র সৈকত থেকে একটু ভিতরে-

হোটেলের মধ্যে - কুয়াকাটা ইন (01712-849373, 01750008177), বীচ হেভেন, হোটেল মোহনা (01750095337), হোটেল বনানী প্যা লেস কুয়াকাটা (01713-674192), হোটেল নীলাঞ্জনা, রাখাইন মার্কেট (01712-927904), সাগর কণ্যা রিসোর্ট লি:, পশ্চিম কুয়াকাটা (01748-424729), বিশ্বাস সি প্যাালেস হোটেল, বেড়ি বাধ (01730-093356)

সাশ্রয়ী হোটেলের মধ্যে- হোটেল উদয় অস্ত, হোটেল সাগর, সমুদ্র বিলাস (ভাড়া ৩০০+ ডবল বেড) ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে।

বি: দ্র: এখানকার হোটেলগুলোর ভাড়া ব্যাপক উঠানামা করে। হোটেলগুলোর পাবলিশড রেট থেকে ৪০-৫০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। তাই অবশ্যই হোটেল বুকিং-এর সময় বারগেইন করবেন। তবে বড় বন্ধের সময় ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। তাই বুকিং দেওয়ার সময় ভালোভাবে কথা বলে কনফার্ম হবেন। সম্ভব হলে ফোনালাপের রেকর্ড রাখবেন।

কি খাবেন?
======
মাছ খাবার জন্য কুয়াকাটা একটি আদর্শ জায়গা। বীচ এর কাছে কয়েকটি অস্থায়ী দোকানে মাছ নিয়ে বসে থাকে। কোরাল মাছ খেয়ে মজা পাবেন। যাই খান না কেন, অনাকাংখিত ঝামেলা এড়াতে দরদাম করে খান।দামাদামি করে ঠিক করে দিলে সামনে বসে ভেজে বা রেধে দেবে।
এছাড়া হোটেল ক্ষেপুপাড়া, তরঙ্গ রেষ্টুরেন্ট, কুয়াকাটা বীচ রেস্টুরেন্ট সহ নানান রেষ্টুরেন্ট এ খেতে পারেন। মানুষ বেশী হলে ফ্রিজে রাখা মাছ দাম ঠিক করুন এরপর রান্না করে দিতে বলুন। এছাড়া জেলেদের কাছ থেকে তাজা ইলিশ কিনে রেষ্টুরেন্ট এ দিলে ওরা রান্না করে দেবে কিছু টাকার বিনিময়ে।

বিঃ দ্রঃ
=====
অাপনার যে কোন সমস্যায় ট্যুরিষ্ট পুলিশের সাহায্য নিন। এখানকার ট্যুরিষ্ট বেশ কো-ওপারেটিভ। ট্যুরিষ্ট পুলিশের ফোন নম্বর: ০১৭-৬৯৬৯০৭৪০।

ভ্রমন কালে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে এবং নিজের দলের অন্যদের বিরত রাখুন।দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে অবদান রাখুন। অাপনার ভ্রমন উপভোগ্য এবং নিরাপদ হোক।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

বান্দরবান ভ্রমন গাইড

সেন্টমার্টিন ভ্রমনের আদ্যপান্ত