সেন্টমার্টিন ভ্রমনের আদ্যপান্ত


সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।বাংলাদেশে মুল ভূ-খণ্ড (টেকনাফের শেষ প্রান্ত) থেকে ৯ কিলোমিটার। সেন্টমার্টিন দ্বীপ অত্যন্ত ছোট একটি দ্বীপ যার অায়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটি ছোট হলেও এর অঙ্গে অঙ্গে ছড়িয়ে ছটিয়ে অাছে অপূর্ব রূপ যা কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফরে দেখা সম্ভব নয়। সেন্টমার্টিন-এর সৌন্দয্য পুরোপুরি উপভোগ করতে হলে সময় নিয়ে এবং ভালো প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।
থাকবেন কোথায়?
পুরো সেন্টমার্টিন জুড়েই এখন হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। তবে থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে অাপনি কেমন পরিবেশ পছন্দ করে তার উপর।যেমন অাপনি যদি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন সেক্ষেেত্র অাপনাকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের মাঝামাঝি কোন হোটেল/রির্সোর্টে থাকতে হবে।কিন্তু অাপনি যদি ভীড় অপছন্দ না করেন তবে জেটির অাশেপাশের কোন হোটেল/রিসোর্ট অাপনার জন্য উপযুক্ত। লোকেশনের দিক বিবেচনায় কয়েকটি উত্তম হোটেল হলো- হোটেল সিটিবি, ব্লু-মেরিন, অবকাশ, সমুদ্র বিলাস, লাবিবা ইত্যাদি।
থাকা খাওয়ার খরচ কেমন পড়বে?
সেন্টমার্টিনে থাকা-খাওয়ার খরচটা নির্ভর করে অাপনার রুচি ও চাহিদার ওপর। এখানে ২৫০/৩০০/- টাকায় রাত যাপনের যেমন ব্যবস্থা রয়েছে তেমনি একরাতের জন্য ১০,০০০/১৫,০০০/-টাকায় অপেক্ষাকৃত বিলাসবহুল থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। খাওয়ার খরচের ক্ষেত্রেও হোটেলভেদে তারতম্য হয়ে থাকে। তবে দেশের অন্যান্য পর্যটন গন্তব্যের তুলনায় এখানে খাওয়ার খরচ কম। ৩০০/- টাকা থেকে ৫০০/-টাকার মধ্যে দিনের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন।
কিভাবে সাজাবেন অাপনার সেন্টমার্টিন ভ্রমন?
সেন্টমার্টিন ভ্রমনের জন্য অন্তত ২ রাত হাতে নিয়ে যান। নিচে একটি ট্যুর প্ল্যান দেওয়া হলো। ট্রাই করে দেখতে পারেন।
সময় নির্বাচন
সাধারণত সেপ্টেম্বর/অক্টোবর থেকে মার্চ/এপ্রিল পর্যন্ত সেন্টমার্টিন-এর জন্য পিক সিজন ধরা হয়। অাপনি এমন একটি সময় নির্বাচন করা উচিত্ যখন খুব ঠান্ডা বা গরম কোনটাই থাকবে না। অর্থাত্ শীতের শুরু বা শেষের দিকের সময়টা সেন্টমার্টিন ভ্রমনের জন্য উত্তম এজন্য যে, অাপনাকে খুব বেশি শীতের কাপড় বহন করতে হবে না এবং পানিতে নামতে কষ্ট হবে না। তাছাড়া শীতের সময় গেলে বেশি সময় ধরে সী-বীচে থাকা যায় না। সময় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অারেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চন্দ্রের হিসাব। জোত্সা রাতে সেন্টমার্টিন অপূর্ব মায়াবী অাকার ধারণ করে। সে সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে অাপনাকে অবশ্যই চঁাদনি রাত মাথায় রেখে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যেতে হবে।
প্রথম দিন
টেকনাফের দমদমিয়া থেকে সেন্টমার্টিনগামী সবক’টি জাহাজই ৯.৩০- ১০.০০ মধ্যে রওনা হয়ে মোটামুটি ১২.৩০ নাগাদ সেন্টমার্টিন গিয়ে পেঁৗছে যায়। সেন্টমার্টিন পেঁৗছে প্রথমে হোটেলে (হোটেল পূর্ব থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়াই উত্তম; নাহলে হোটেল খুঁজতে গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে) গিয়ে জিনিসপত্র রেখে পোশাক পরিবর্তন করে সমু্দ্র স্নান করে নিন।সমুদ্র স্নানের জন্য উত্তম বীচ হলো জেটি থেকে নেমে হাতের ডানে গিয়ে বঁায়ে যে বীচটি পড়ে সেটি।এখানে সমুদ্র অগভীর, পানি স্বচ্ছ এবং এটি প্রবাল মুক্ত।তবে জেটি থেকে ডানে গিয়ে ঠিক কোনার স্থানটি বিপদজ্জ্বনক।এখানে কয়েক বছর অাগে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ডুবে মারা গিয়েছিল।
এ স্থান ছাড়াও হোটেল অবকাশের পাশ্ববর্তী বিচে গোসল করা যেতে পারে। জোয়ারের সময় এখানে গোসল সহজ হলেও ভাটার সময় বিস্তীর্ণ এলাকা শুকিয়ে যায় বলে এ বীচে গোসল করতে হলে বেশ খানিকটা দূরে যেতে হয়।গোসল শেষে হোটেলে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে। বিশ্রাম শেষে বিকেল ও সন্ধ্যাটা সমুদ্র বিলাসের পাশের বীচে কাটানো যায়।এসময় এ বীচে মাছ ও কাকঁড়া ভাজা হয়। সেন্টমার্টিনের কঁাকড়া ও মাছ ভাজার স্বাদ নিতে পারেন।
সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এখানকার নিরাপত্তা। একদিকে পর্যটন নির্ভরতা অন্যদিকে কোস্টগার্ড-এর উপস্থিতি দ্বীপটিকে নিরাপদ রেখেছে। তাই নিরাপত্তা এখানে কোন সমস্যা নয়। চঁাদনী পসর রাতে সারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ চষে বেড়াতে পারে বন্ধুবন্ধবীসহ। রাত ১২টার পর জোয়ার স্নাত বীচে হাঁটতে পারেন কিম্বা কোলাহল থেমে যাওয়া জেটিতে দাড়িয়ে ঢেউয়ে উত্তাল বিস্তীর্ণ জলরাশীতে চঁাদের অালোর নৈসর্গিক দৃশ্যে উপভোগ করতে পারেন ।
২য় দিন
দ্বিতীয় দিনে অাপনার অবশ্য গন্তব্য হবে ছেড়া দ্বীপ।এ অালাদা কোন দ্বীপ না হলেও জোয়ারের সময় সেন্টমার্টিন, থেকে বিছিন্ন হয়ে অালাদা দ্বীপের অাকার ধারণ করে বলে এর এরকম নামকরণ। একটু ধীরে সুস্থে ঘুম থেকে উঠুন। জেটি থেকে স্পীডবোট বা ট্রলারে করে যেতে পারেন।ট্রলারে প্রায় ৪৫/৫০ মিনিট অার স্পীডবোটে ১০/১২ মিনিট লাগে। ট্রলারে যেতে চাইলে অবশ্যই সান ক্যাপ/হ্যাট নিয়ে যাবেন। (প্রচন্ড রোদে অার ইঞ্চিনের শব্দে ট্রলারে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়াটা বেশ বিরক্তিকর) যাওয়ার পথে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে যেতে পারেন। ছেঁড়া দ্বীপে ডাব ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায় না। সকাল ১০টার দিকে রওনা হলে ছেঁড়া দ্বীপ পেঁৗছাতে পেঁৗছাতে ভাটা লেগে যাবে। ছেঁড়া সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপ যাতায়াতের রাস্তা দৃশ্যমান হতে থাকবে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। সমুদ্র বুক চিড়ে বিশাল এক রাস্তার ভেসে উঠা। তবে ছেঁড়া দ্বীপের সবচেয়ে অাকর্ষণীয় অংশ এর সর্বশেষ প্রান্ত ও তার সংলগ্ন অংশ। সমুদে্রর বিশাল বিশাল ঢেউ সেখানে অঁাচড়ে পড়ে প্রকান্ড শিলা পাথরের উপর।
ছেঁড়া দ্বীপ দর্শনে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না।দুপুরের পর ভাটার সময় ছেঁড়া দ্বীপ তার সৌন্দয্য হারায়। তাই দুপুরের পর ছেঁড়া দ্বীপে সচরাচর পর্যটক থাকে না। হোটেলে ফিরে গোসল ও খাওয়া সেরে নিন। মনে ও পায়ে জোর থাকলে সারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ (বীচ ধরে) পদক্ষিণ করতে পারেন। দ্বীপটি যে কতটা বৈচিত্রময় সেটি পুরুটা দ্বীপ পদক্ষিণ না করলে বুঝা যায় না। তবে এই বৈচিত্রময়তা শুধু পশ্চিম/জেটি উল্টা দিকের বীচে দেখা যায়। কোথাও শুধু প্রবাল, কোথায় বিস্তৃর্ণ প্রায় সমতল, কোথায় খাড়া বীচ; অাবার কোথায় যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাথর অার পাথর। মনে হয় কেউ যেন পাথরগুলোকে এখানে স্তুপকৃত করে রেখেছে। কোথায়ও অাবার চোখে পড়বে ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের বন, কোথাও পাথর মাটিতে মিশে যাওয়ার দৃশ্য।সম্পূর্ণ দ্বীপ ঘুরে অাসতে সময় লাগবে ৪ ঘন্টার মত। ৩টার দিকে সমুদ্র বিশাল বা হোটেল অবকাশের পাশ দিয়ে শুরু করে জেটিতে এসে পেঁৗছাতে ৭টা থেকে ৮টা বেজে যাবে। রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ুন।
৩য় দিন
তৃতীয় দিনে খুব ভোরে উঠে জেটিতে চলে যান সূর্যদয় দেখার জন্য। মিয়ানমারের পাহাড়ের অাড়াল থেকে দৃশ্যমান হয় সূয্য। সূর্যদয় দেখার সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো জেটি/লঞ্চ ঘাট। সকালের শান্ত সেন্টমার্টিন অাপনাকে অন্য রকম অনুভূতি দিবে । পরের কিছুটা সময় সেন্টমার্টিনের মানুষদের জীবন ও তাদের কৃষিকাজ দেখতে পারেন যদি অাগ্রহ থাকে। মালিকের অনুমতি নিয়ে এবং টাকা দিয়ে গাছ থেকে ডাব পেড়ে খেতে পারেন। সকাল ১০ টার দিকে শেষবারের মত সেন্টমার্টিনের সমুদ্র সৈকতে গা ভিজিয়ে নিতে পারেন। সময় পেলে শুটকি কেনাসহ অন্যান্য কেনাকাটা বা মার্কেট ঘুরে দেখতে পারেন। এরপর হোটেল ছেড়ে দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিন।
যাবেন কিভাবে?
ঢাকা থেকে অনেকভাবে যাওয়া যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। অাপনি কোন রুট ব্যবহার করবেন সেটি নির্ভর করে অাপনার সময়, ব্যক্তিগত পছন্দ, বাজেট ইত্যাদির ওপর। তাছাড়া অনেকেই সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার একত্রে ভ্রমন পরিকল্পনা করে থাকেন। তাই ঢাকা থেকে ট্যুর হতে পারে কয়েক রকম।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার:
নন এসি/ এসি/ স্লিপার কোচ/বিমানে করে যেতে পারেন কক্সবাজার
ট্রেন যোগে: যাদের বাজেট কম এবং ট্রেন ভ্রমন পছন্দ করেন তারা ট্রেন যোগে চট্রগ্রাম গিয়ে সেখান থেকে বাসে চলে যেতে পারেন কক্সবাজার। অল্প খরচের পাশাপাশি ট্রেন ভ্রমণের অানন্দ নিতে পারেন।তবে সেক্ষেত্রে সময় একটু বেশি লাগবে।
যে কোন উপায়ে কক্সাবাজার যাওয়ার পর কলাতলির ডলফিন চত্ত্বর থেকে বাস ও মাইক্রোবাসের মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে দমদমিয়া (টেকনাফ) জাহাজ ঘাট যেতে পারেন যেখান থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়ে। মনে রাখতে হবে, সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের সবগুলো সকাল ৯.৩০ টার দিকে ছাড়ে। সুতরাং সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।
সরাসরি:
ঢাকার গাবতলী/কল্যাণপুর/শ্যামলী/অারামবাগ/সায়দাবাদ/যাত্রাবাড়ীসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে এসি/নন-এসি বাস সার্ভিস রয়েছে যেগুলো অাপনাকে সরাসরি জাহাজ ঘাট নিয়ে অাসবে জাহাজ ছাড়ার সময়ের পূর্বেই। সাধারণত বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব বাস ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়।
দমদমিয়া থেকে বেশ কয়েকটি জাহাজ সেন্টমার্টিন পারাপারের কাজ করে থাকে। এগুলো খরচ এবং সার্ভিস ভিন্ন ভিন্ন।কম খরচের মধ্যে রয়েছে এমভি বাঙ্গালী, এমভি কাজল, এলসিটি কুতুবদিয়া ইত্যাদি। মধ্যমানের মধ্যে রয়েছে কেয়ারী সিন্দবাদ এবং ব্যয়বহুল জাহাজের মধ্যে রয়েছে কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন ও গ্রীনলাইন ক্রুজার। তবে জাহাজগুলোর প্রত্যেকটির সীটের অবস্থান ও ধরণের ভিত্তিতে ভ্রমন মূল্যের তারতম্য রয়েছে।
বিশেষ অনুরোধ: অামাদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব অামাদেরই। এ সম্পদ এমনভাবে উপভোগ করুন যাতে অাপনার ভবিষ্যত বংশধররা তা থেকে বঞ্চিত না হয়। অাপনার ভ্রমন উপভোগ্য ও নিরাপদ হোক।

Comments

Popular posts from this blog

বান্দরবান ভ্রমন গাইড

সাগরকন্যা কুয়াকাটা ভ্রমন